সাদিও মানে, একজন ফুটবলার। বর্তমানে লিভারপুলের হয়ে খেলছেন। তাঁর শুধু সাপ্তাহিক আয় প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা।
সাদিও মানে ১৯৯২ সালের ১০শে এপ্রিল তারিখে সেনেগালের সেদিউয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই তার শৈশব অতিবাহিত করেছেন। দরিদ্রতা, নিরক্ষরতা আর জীবনমানের অবক্ষয়- হাজার চব্বিশেক মানুষকে করেছে কোনঠাসা। এই পরিবেশে বেড়ে উঠছে শতশত শিশু কিশোর; প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে সোনালী সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত যারা মত্ত থাকে ফুটবল খেলায়। হোক জরাজীর্ণ রাস্তা, কিংবা এক টুকরো পরিত্যক্ত জমি- ফুটবল খেলতে পারার আনন্দে পরিতুষ্ট ছেলেগুলো! অন্য সব ছেলের মতোই সাদিও মানের গড়ন, বিশেষত্বহীন চেহারা, নির্জীব নিষ্ক্রিয় চোখ! ব্যতিক্রম কেবল মনোবল, মানুষিকতার।
বর্তমানে আফ্রিকার সবচেয়ে দামি ফুটবলার! সাদিও নামের ছেলেটা ফুটবলের মাধ্যমে আজ সারাবিশ্বে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ইতিমধ্যেই ক্লাবের হয়ে জয় করে নিয়েছে ইউরোপ! ব্যক্তিগতভাবে, মানে বেশ কিছু পুরস্কার জয়লাভ করেছেন, যার মধ্যে ২০১৮–১৯ প্রিমিয়ার লীগের গোল্ডেন বুট এবং ২০১৯ সালে বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলারের পুরস্কার জয় অন্যতম। দলগতভাবে, মানে এপর্যন্ত ৬টি শিরোপা জয়লাভ করেছেন, যার মধ্যে ২টি রেড বুল জালৎসবুর্গের হয়ে এবং ৬টি লিভারপুলের হয়ে জয়লাভ করেছেন।
একজন সেনেগালীয় প্লেয়ার হওয়া স্বত্ত্বেও বিশ্ব ফুটবলে সাদিও মানে এখন এক অবিস্মরণীয় নাম। লাখো বঞ্চিত আফ্রিকান শিশু কিশোর, যুবকের আইডল সে। চ্যাম্পিয়নস লীগ জয় করে সে কোনো লাক্সারিয়াস ম্যানশন বুক করে হলিডে কাটাতে পারতো। অথচ, সে কিনা চলে যায় তার গ্রামবাসীর কাছে। যেই গ্রামবাসীর কাছে আকাশস্পর্শী মানুষ সে!
লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের হয়ে সপ্তাহে $১৬৭ হাজার ডলার আয় করা সাদিও মানে ব্যাক্তি জীবনে দয়ালু,ধার্মীক এবং অত্যন্ত সজ্জন। অঢেল অর্থ আয় করলেও দরিদ্র গ্রামবাসীর কথাসব সময় মনে রেখেছেন। তাইতো, ২০১৮ সালে তাদের জন্য $৩০০ হাজার ডলার খরচ করে একটি স্টেডিয়াম বানিয়ে দিয়েছেন সাদিও মানে। সেই সাথে একটি স্কুল, একটি মসজিদ এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য গ্রামবাসীকে একটি হাসপাতাল নির্মান করে দিয়েছেন!
গ্রামের যে সকল মানুষ তাকে আজ এই পজিশনে নিয়ে আসতে সাহায্যে করেছেন, তাদেরকে কখনোই ভুলে যান নি মানে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়- লিভারপুলে জয়েন করার পরেই তার গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষকে ৫০,০০০ সিএফএ ফ্রাঙ্কস বা ৮৫ ডলার করে উপহার দেন সাদিও মানে।
তিনি একজন অনুশীলনকারী মুসলমান এবং প্রতিটি ম্যাচ শুরুর পূর্বে তাকে দুয়া করতে দেখা যায়। লিভারপুলে যোগ দেয়ার পর মানে জানিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে তার আলাদা একটা স্পেস লাগবে। কারণ তিনি সালাত আদাত করতে চান। লিভারপুল টিম ম্যানেজমেন্ট তার জন্য ড্রেসিংরুমের সাথে একটা ছোটখাটো মসজিদ বানিয়ে দিয়েছে!
হাতে তাঁর ভাঙ্গা আইফোন। এমন ভাঙ্গা ফোন ব্যবহার করেন কেন, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে একটা সাক্ষাতকারে সাদিও মানে বললেন, ’এমন মোবাইল চাইলে হাজারটা কেনা যায়। চাইলে ১০ টা ফেরি, ২ টা জেট বিমান, হাজার খানেক ডায়মন্ডের ঘড়ি কিনতে পারি। কিন্তু এসব কী আমার সত্যিই প্রয়োজন? এগুলো শুধু বৈষয়িক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের রুচি খুবই নিম্নমানের না হলে কেউ বিশ-ত্রিশ হাজার ডলারের ঘড়ি হাতে দিয়ে ঘুরবে না। আর এসবের মাধ্যমে আমার এবং সমাজের কোনো উপকারে আসবে? যেই মুহুর্তে আমার নিঃশ্বাস শেষ, সেই মুহুর্ত থেকে এসবের মালিকানাও শেষ।’
সাদিও মানে আরও বলেন, ’দারিদ্র্যের কারণে আমি পড়ালেখা করতে পারিনি। আমি শিক্ষিত না। তাই হয়তো শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেছি। দরিদ্র ছিলাম বলেই হয়তো জীবনের আসল অর্থ বুঝেছি। কিন্তু দুনিয়ায় আজ যারা বড় শিক্ষিত, তারাই শিক্ষার গুরুত্বটা ঠিকঠাক বুঝছেন না। যদি বুঝতেন, তবে দুনিয়াতে এতো অভুক্ত শিশু না খেয়ে রাতে ঘুমোতে যেত না। মানুষ দিন দিন এভাবে ভোগ-বিলাসের কয়েদি হয়ে উঠত না।’
সাদিও বলেন, ‘আমি নিজের বিলাসবহুল বাড়ির পরিবর্তে অসংখ্য স্কুল তৈরি করেছি, দামি পোষাকে ওয়াড্রব ভর্তি না করে বস্ত্রহীন মানুষকে বস্ত্র দিয়েছি, নিজে দামি গাড়ি চালানোর পরিবর্তে অগণিত স্কুল শিক্ষার্থীদের স্কুল বাসের ব্যবস্থা করেছি, প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে দামি রেস্টুরেন্টে না খেয়ে অগণিত ক্ষুধার্ত শিশুর খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি, এটা আমি জানি।’
সত্যিই, সাদিও মানে মত হওয়া কিন্তু যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। প্রতিটি মানুষের জীবনে সাদিও মানে আদর্শ হয়ে থাকুক আজীবন।