Monday, December 9, 2024
No menu items!
জাতীয়তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, রাণীমা ইলা মিত্রের আজ ৯৬তম জন্মদিন

তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, রাণীমা ইলা মিত্রের আজ ৯৬তম জন্মদিন

ইলা মিত্রের আজ ৯৬তম জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তাদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকুরির সুবাদে তারা সবাই কলকাতায় থাকতেন। এ শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন, লেখাপড়া করেন কলকাতার বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে স্নাতক শ্রেণিতে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। কৈশোরে তিনি খেলাধুলায় তুখোড় ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি.এ সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে ঐ বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতে তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।

১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় দেশকর্মী কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্রের সাথে। রমেন্দ্র মিত্র মালদহের নবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার মহিমচন্দ্র ও বিশ্বমায়া মিত্রের ছোট ছেলে। বিয়ের পর বেথুনের তুখোড় ছাত্রী ইলা সেন হলেন জমিদার পুত্রবধূ ইলা মিত্র। কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে। হিন্দু রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের নিয়মানুসারে অন্দরমহলেই থাকতেন ইলা মিত্র। তখনও তিনি মা হননি, তাই হাতে অফুরন্ত অবসর। এই বন্দি জীবনে মুক্তির স্বাদ নিয়ে এলো গ্রামবাসীর একটি প্রস্তাব। রমেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ির কাছেই কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলা হলো। গ্রামের সবাই দাবি জানালেন তাদের নিরক্ষর মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নিতে হবে বধূমাতা ইলা মিত্রকে। বাড়ি থেকে অনুমতিও মিললো, কিন্তু বাড়ির চার’শ গজ দূরের স্কুলে যেতে হয় গরুর গাড়ি চড়ে। মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও ইলা মিত্রের আন্তরিক পরিচালনায় তিনমাসের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০-এ। আর এর মধ্যে তিনি হেঁটে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি লাভ করতেও সক্ষম হন। সংগ্রামী নেত্রী এভাবেই অন্দর মহল থেকে বের হয়ে এসে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর সমাজ সেবার কাজে। হয়ে ওঠেন এলাকার রানীমা।

১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন ইলা মিত্র।বর্গা বা ভাগ-চাষীরা এতে অংশ নেয়। মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত।এই আন্দোলনের জনক নামে খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ। আগে বর্গাপ্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগ-চাষীর জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরও কম বরাদ্দ থাকত। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দু’টোই কৃষক দিত। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল।

১৯৪৬-১৯৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় সূচিত এক যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি প্রান্তিক চাষীদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। এ সময় ইলা মিত্র নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত গ্রাম হাসনাবাদে পুনর্বাসনের কাজে চলে যান। তখন নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করছিলেন। ইলা মিত্রের এই সাহসী পদক্ষেপ সে সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্র পূর্ব-পাকিস্তানেই রয়ে গেলেন। পাকিস্তান হবার পরও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন হয়। মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হলে তারা কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমন করে। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পার্টির শীর্ষ স্থানীয় হিন্দু নেতাদের প্রায় সকলকেই দেশ ছাড়া করা হয়। সরকারের এই দমননীতির ফলে কমিউনিস্টও কৃষক আন্দোলনের নেতারা আত্মগোপন করে কাজ করতে থাকেন। ইলা মিত্র এবং রমেন্দ্র মিত্রও নাচোলের চণ্ডীপুর গ্রামে আত্মগোপন করে থাকেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করেন। ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই বীর নারী ৭৬ বছর বয়সে কলকাতায় ইহলোক ত্যাগ করেন।

ইলা মিত্র অনেক বই রচনা করেন। হিরোশিমার মেয়ে বইটির জন্য তিনি ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু’ পুরস্কার লাভ করেন। এ্যাথলেটিক অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ভারত সরকার তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে ‘তাম্র পদক’ এ ভূষিত করে সম্মানিত করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে জনপ্রিয় খবর

সাম্প্রতিক মন্তব্য