‘২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ ছিল। সে সময় আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজারের বেশি এবং মারা যায় ২৮১ জন। তবে এবার সেটাও ছাড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এবার ২৫ জুলাই পর্যন্ত ১৩১ জন মারা গেছে। এক মাসেই আক্রান্ত প্রায় ২৫ থেকে ২৬ হাজার। যদিও বলা হচ্ছে ৩৭ হাজার আক্রান্ত, মৃত্যু প্রায় ২০১ জন হয়ে গেছে। আসলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।’
বুধবার (২৬ জুলাই) জাগো নিউজ কার্যালয়ে ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ: সচেতনতায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে ডেঙ্গু পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে এমন আশঙ্কার কথা বলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, অনেকের ঘরেই জ্বরের রোগী আছে, চিকিৎসা নিচ্ছে না। ঘরে থেকেই ভালো হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোতো রিপোর্টে আসে না। তবে এভাবে যদি বাড়তে থাকে অবস্থা আগামী এক থেকে দুই মাসে আরও খারাপের দিকে যাবে। যত আক্রান্ত হবে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু যখন বেড়ে যায় তখন তোড়জোড় শুরু হয় মশা মারার, আগে কোনো খবর থাকে না। এখন ডেঙ্গু বেশি, ড্রোন নিয়ে আসছে তবে কী লাভ হবে জানি না। এসব কোনো কাজেই আসবে না। আর যে জরিমানা করা হয়েছে তা মানুষকে হয়রানি করা ছাড়া কিছু না। এতে করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলে তো লাভ নেই। এসব বন্ধ করে কাজ করে দেখিয়ে দেন আপনি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। এখানে কাউকে ব্লেইম গেম করেও লাভ নেই।
এই চিকিৎসক বলেন, সিটি করপোরেশনকে একা দোষ দিয়েও লাভ নেই। এখন তো ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে গেছে। ঢাকায় ও কিছু এলাকা আছে যেখানে সিটি করপোরেশন যেতে পারে না। এছাড়া একপাশে মশা নিয়ে গবেষণা না করে সমন্বয় করা দরকার। যেমন, উত্তরে মশা তাড়ালে দক্ষিণে মশা চলে যাবে। তাদের তো আর পাসপোর্ট, ভিসা নেই।
গবেষণা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার জানিয়ে এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, গবেষণা তো একদিনে হয় না। এই মুহূর্তে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নির্মূল করতে হবে। আমরা তো শত্রু চিনি। দৃশ্যমান শত্রু। করোনা তো অদৃশ্য শত্রু ছিল। গবেষণা তো আর তাড়াহুড়ো করে হবে না। এটি চলমান প্রক্রিয়া। আপাতত মশাকে মারতে হবে। এখন দোষ দিয়ে লাভ নেই, জনগণকে মশা থেকে বাঁচাতে যা যা করণীয় তাই করতে হবে। কারণ আমরা সিটি করপোরেশনকে যতই দোষ দেই লাভ হবে না। তারা বহুতল ভবনের ভেতরে ঢুকে তো মশা মারতে পারবে না। আর কেউ দরজা খুলে তাদের মশা মারার জন্য দরজা খুলেও দেবে না। লোকবলও নেই। কোনো সিটি করপোরেশন শত শত লোক দিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে মশা নিধন করতে পারবে না। এটা বাস্তবের সঙ্গে সামাঞ্জস্যও না। এই মশা ভদ্র মশা। আজেবাজে জায়গায় কম থাকে। গৃহপালিত মশার মতো, ঘরেই থাকে। সে জন্য এটায় জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে ধর্মীয় গুরুদেরও এই কাজে সংযুক্ত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক আরও বলেন, মশা যে দেশে ঢোকে সেখান থেকে বের হয় না। সিঙ্গাপুরের কথা বলা হচ্ছে সেখানে মানুষ কম, সব মানুষ শিক্ষিত, রাস্তাঘাট পরিপাটি। তবুও ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে। তাই একতরফা দোষ দিয়ে লাভ নেই।
তিনি বলেন, ডব্লিওএইচ ও এরই মধ্যে বলেছে পৃথিবীর অর্ধেক লোক ঝুঁকিতে আছে। এতে শুধু আমরা আছি তা কিন্তু না। ১২৯টা দেশে হয়েছে। ৫৮ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিলে এটি নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি অসম্ভব হবে তা আমার মনে হয় না। এবার শিক্ষা থেকে আমরা যদি সারাবছর মশা মারার কার্যক্রম চালাই তাহলে আমরা এটা পারবো। আবার এখানে যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, এতে করে পরিবেশও নষ্ট হয়। অনেকগুলো জীবজন্তু আছে যেগুলো মশাকে খায় সেগুলোও মারা যায়। আর এসব কেমিক্যাল মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে গিয়ে বুকেরও সমস্যা হচ্ছে। জিনিসটা এত সহজও না।
ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের তেমন দরকার নেই জানিয়ে এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু হলে আবার অনেক রক্ত দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। তবে রক্ত দেওয়ার দরকার নেই ডেঙ্গু মশার জন্য। রক্ত তখনই লাগে যখন রোগীর রক্তপাত হয়। সেখানে চিকিৎসক চাইলে রক্ত দিতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গু হলেই যে ব্লাড দিতে হবে এমনটা না। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে খুব বেশি প্লাটিলেট প্রয়োজন হয় না। যারা মারা যায় তারা প্লাটিলেট কমের জন্য মারা যায় না। অনেক মারা যায় প্লাজমা লিকেজের ফলে। শরীর থেকে লিকুইড চলে যায়। যেমন প্রেসার কমে যায়, প্রস্রাব হয় না, কিডনি ফেইলিউর, লিভার ফেইলিউর শকে চলে যায়। আর রোগীরা এসব কারণে মারা যায়। এ কারণে অযথা প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তিত হবেন না। বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগের প্লাটিলেট বা রক্ত লাগে না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু করোনার মতো কোনো অঙ্গকেই বাদ দেয় না। কিডনি-হার্ট সবকিছুকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। সাধারণত প্লাটিলেট তিন থেকে চারদিন পরে কমে। এক্ষেত্রে জ্বরের প্রথম দিকে যদি প্লাটিলেট টেস্ট করে তাহলে সমস্যা ধরা নাও পড়তে পারে। কারণ অনেকে ভালোই তো আছি মনে করে। এনএস১ অ্যন্টিজেন করা হয় এটি এক থেকে তিনদিনের মধ্যে বোঝা যায় ডেঙ্গু আছে কি না। আবার আইজিজি আইজিএম এক-দুই দিনের মধ্যে করলে নেগেটিভ আসবে। এটি চার-পাঁচ দিন পর করতে হয়।
৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ঘরে বসেই চিকিৎসা নিতে পারে। তাদের মাঝে ১০ থকে ২০ শতাংশের হাসপাতালে নেওয়া লাগতে পারে। আর তারও এক থেকে পাঁচ শতাংশ আইসিইউ লাগে। রোগীদের সমস্যা দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে পারে। তবে অযথা ফার্মেসি থেকে ব্যথার ওষুধ দেওয়া যাবে না। অন্য কোনো ওষুধ দিলে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা বাড়ে। তবে বেশি ব্যথা হলে প্যারাসিটামল খেতে পারেন। বেশি খেলেও সমস্যা নেই। দুইটা, তিনটা খেলে সমস্যা হবে না। নিজের ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাবেন না। ডেঙ্গু ভাইরাসে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়াও যাবে না তা কিন্তু বলা যাবে না। ডেঙ্গুর সঙ্গে টাইফয়েড হয়, অনেক সময় বাচ্চাদের নিউমোনিয়া হয়। তাহলে তাদের কি সেই অ্যান্টিবায়োটিক দেবে না। অনেকে মনে করে অ্যান্টিবায়োটিক দিলে ডেঙ্গুর ক্ষতি হবে। সেটাও ঠিক না। নিজেরা দোকান থেকে কিনে খাবে না, এটি হচ্ছে জরুরি।
তিনি বলেন, হাসপাতালে নেবেন যখন রোগী খেতে পারে না, পাতলা পায়খানা হয়, বমি হয়, রুচি নেই, প্রেসার কমে যাচ্ছে তখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আর বয়স্কদের একটু ঝুঁকি বেশি থাকে তাই তাদের হাসপাতালে থাকাটা ভালো। এছাড়া যেমন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে। গতদিন একজন মারা গেলো। আর একজন রোগী আমার কাছে এসেছিল, প্রায় জ্বরের ৭-৮ দিন পর। যদিও তিনি মারা যাননি তবে গর্ভের সন্তান অ্যাবরশন হয়ে গেছে।
এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, দেখা যায়, দু-একদিন জ্বর, সর্দি, কাশি এসব হচ্ছে। এরপরই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই শুরুতেই অবহেলা না করে ডেঙ্গু টেস্ট করে নিতে হবে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেবেন।