বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে এলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের ওপর সতর্ক নজর রাখছে বাংলাদেশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ধরনটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। ইতিমধ্যেই এ ধরনটির বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতি নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরকে চিঠি লিখেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত আইইডিসিআরের উপদেষ্টা। চিঠিতে দেশের ‘পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে’ কঠোর নজরদারি বাড়ানো এবং যত রোগী পাওয়া যাচ্ছে সবার জিনোম সিকোয়েন্স করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ’৯ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ শনাক্ত হয়।’ ভ্যারিয়েন্টটি কোভিড জীবাণুর সবচেয়ে বেশি মিউটেট হওয়া সংস্করণ যা অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে ওমিক্রনই সবচেয়ে মারাত্মক। বিজ্ঞানীরা এখনো করোনার এ নতুন ধরন সম্পর্ক খুব বেশি জানতে পারেননি। তবে এটা খুবই উদ্বেগের বলে সতর্ক করেছেন তারা। করোনার এ ধরন কতটা সংক্রামক, তা বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সংস্থা বলেছে, করোনার নতুন এ ধরনে যে স্পাইক প্রোটিন রয়েছে, সেটি মূল করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন থেকে ভিন্ন। আর ওই স্পাইক প্রোটিনকে বিবেচনায় নিয়েই করোনার টিকাগুলো তৈরি করা হয়েছে। সে কারণে এসব টিকা করোনার নতুন ধরনটির ক্ষেত্রে কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে এটি অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার বলেছে, নতুন ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয়েছে আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায়। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন (ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন ) ১১টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করেছে। সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করার ঘোষণ দিয়েছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ধরন নিয়ে বাংলাদেশে এখনই অত বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনার নতুন ধরনের রোগী এখন পর্যন্ত খুবই কম পাওয়া গেছে। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানাতে পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের স্পাইক প্রোটিনে ৩২টা মিউটেশন রয়েছে। এখন স্পাইক প্রোটিন যেহেতু ভ্যাকসিনের একটা কার্যকরী অবস্থা তৈরি করে, এই ধরন সেটা কমিয়ে দিতে পারে। তবে এখনো তেমন কোনো প্রমাণিত হয়নি। যেহেতু অনেকগুলো মিউটেশন হয়ে গেছে, সেজন্য এ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এটা নিয়ে এখনো এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সারা পৃথিবীতে মাত্র ১০-১২টা কেস। কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। দেশের ভাইরাসের সিকোয়েন্স করছি। আমাদের এ অঞ্চলে এখনো এই রকম কিছু পাওয়া যায়নি।’
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার গৌতেং প্রদেশে ৭৭ জনের দেহে এ ধরনটি পাওয়া গেছে। এর বাইরে বতসোয়ানায় চারজন ও হংকংয়ে একজনের দেহে এ ধরন শনাক্ত হয়েছে। এসব রোগী মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া। ধরনটি বেশ দ্রুতগতিতে ছড়ায় বলে প্রাথমিকভাবে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। করোনার নতুন ধরন নিয়ে গতকাল বৈঠক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তারা বলছে, বৈঠকের পর নতুন নির্দেশনা জারি করা হবে। সংস্থাটি বর্তমানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে এবং সরকারকে ঝুঁকিভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে।
নতুন ধরনের বিস্তার ঠেকাতে আবার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও জাপান কোয়ারেন্টাইন জোরদারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের জোটভুক্ত সব দেশেই দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের প্রস্তাব করেছে। গত ১৪ দিনে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশগুলো ভ্রমণ করে আসা ব্যক্তিদের ওপর ইতালিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভাইরাসের নতুন ধরনের এলাকা (ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট এরিয়া) ঘোষণা করছে জার্মানি। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা ও নজরদারিতে রাখতে রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে ভারত। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আফ্রিকার ওই অঞ্চল থেকে লোকজন আসায় বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও পাঁচটি আফ্রিকান দেশ থেকে ভ্রমণকারীদের জন্য সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে জাপান।